বিশ্ব শরণার্থী দিবস: মনোযোগ হারাচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট

নজরুল ইসলাম •

জাতিসংঘের বিশ্ব শরণার্থী দিবসের ঠিক একদিন আগে নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার দাবিতে সমাবেশ করেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা।

ভূ-রাজনীতিতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ইস্যু যুক্ত হচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে পুরোনো ইস্যু। গুরত্বও কমছে। বিশেষ করে টানা দুই বছর কোভিড মহামারির আঘাতের পর আলোচনার কেন্দ্রে এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি বিশ্ব সম্প্রদায়ের মনোযোগ হারাচ্ছে।

যদিও বাংলাদেশ সরকার বিষয়টির সঙ্গে পুরোপুরি একমত নয়। সরকারের ভাষ্য, ঢাকার কূটনৈতিক প্রচারণায় রোহিঙ্গা ইস্যু এখনও বর্তমান। তবে এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও রাখাইনে প্রত্যাবর্তন করতে না পারার খেদ সংশ্লিষ্টদের। চলতি বছরেই রোহিঙ্গাদের একটি দলকে মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন করা সম্ভব হতে পারে বলে আশা প্রকাশ করছেন তারা।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, দুইবার প্রত্যাবাসনের খুব কাছাকাছি গিয়েও মিয়ানমারের কারণে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন শুরু করা সম্ভব হয়নি। প্রত্যাবাসন শুরু করতে সম্প্রতি মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের সঙ্গে শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠক হয়েছে। প্রত্যাবাসন শুরু করতে নেপিডোর সঙ্গে কাজ করছে ঢাকা। রোহিঙ্গাদের ভেরিফিকেশন বা যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া নিষ্পত্তির কাজ চলমান রয়েছে।

এ বছর রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হবে কি না-জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, আমরা তো চাই শুরু হোক। মিয়ানমারও আশ্বাস দিচ্ছে, শুরু করবে। কিন্তু তাদের গ্যারান্টি নেই। তাই এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। তাছাড়া এ ব্যাপারে টাইম ফ্রেম বলা যাবে না। তবে আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে খুব সিরিয়াসলি কাজ করছি। আমাদের চাওয়া প্রত্যাবাসন যখনই শুরু হোক, সেটা যেন টেকসই হয়।

কক্সবাজারের শরণার্থীরা আগে বলেছিলেন, নাগরিকত্ব ও বিচারসহ অন্যান্য দাবি না পূরণ হলে তারা মিয়ানমারে ফিরবেন না।

এক্ষেত্রে চীনের ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ থেকে কোনো সুখবর নেই বলেও জানান মন্ত্রণালয়ের এ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন ইউএনএইচসিআরের হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি। সফরে তিনি রোহিঙ্গা ইস্যু যে ক্রমান্বয়ে ফিকে হচ্ছে সেই ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। সাংবাদিকদের হাইকমিশনার জানান, আফগানিস্তান ও ইউক্রেন সংকটের মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের প্রতি যেন বিশ্বের মনোযোগ হারিয়ে না যায়। রোহিঙ্গা সংকটের দিকে যেন বিশ্বের মনোযোগ বজায় থাকে।

  • দুঃখের বিষয় এখনও একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি।
  • পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন

চলমান বৈশ্বিক উত্তেজনার ফলে শরণার্থীদের তহবিল নিয়ে ‘সংকট’ দেখা দিতে পারে বলেও মত দেন তিনি। আর এ কারণেই তিনি বাংলাদেশ সফরে এসেছেন বলে জানান ফিলিপ্পো।

সদ্য প্রকাশিত জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) বার্ষিক গ্লোবাল ট্রেন্ডসের প্রতিবেদন বলছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর বিশ্বে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি স্পর্শ করেছে। ১০ বছর আগে শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ৪০ মিলিয়ন, যা এখন দ্বিগুণের বেশি। আর শরণার্থীদের আশ্রয়স্থল হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণেই বিশ্বে শরণার্থী পরিস্থিতি এ অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে বলে ভাষ্য সংস্থাটির।

রোহিঙ্গা ইস্যু ক্রমশ গুরত্ব হারাচ্ছে কি না-সম্প্রতি জানতে চায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের কাছে। জবাবে ড. মোমেন বলেন, আফগানিস্তান পরিস্থিতির সময়ে অনেকে বলেছে, রোহিঙ্গা ইস্যু হারিয়ে গেছে। আবার ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ নিয়েও এ কথা বলেছে পন্ডিতরা। কিন্তু আমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে রোহিঙ্গা ইস্যু হারিয়ে যায়নি। বরং আমাদের কারণে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটা এখন পৃথিবীব্যাপী সবাই জানে। আমরা যেখানেই যাই এ প্রসঙ্গটা তুলি। তবে দুঃখের বিষয় এখনও একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি।

ইউএনএইচসিআরের ওয়েবসাইটে জেআরপি তহবিলের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য বলছে, চলতি বছর জেআরপিতে প্রায় ৮৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চাওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত মাত্র ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ তহবিল পাওয়া গেছে। জেআরপির ৮৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চাওয়ার বিপরীতে এখনও ৭৬২ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার পাওয়া যায়নি।

  • পৃথিবীর অন্য জায়গায় কী হচ্ছে না হচ্ছে, সেটার সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যু মেলানো ঠিক হবে না। বরং রোহিঙ্গা বিষয়ে সমাধান যেটা প্রয়োজন সেটার জন্য মিয়ানমার সরকারের ওপর কী ধরনের চাপ বাড়ানো যায় এবং কতখানি বাড়ানো যায় সেটা খেয়াল রাখা দরকার।
    অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ

জেআরপি তহবিলের গত ৪ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতিবছরই রোহিঙ্গা মানবিক তহবিলের পরিমাণ কমেছে এবং কোনো বছরই জেআরপি তহবিলের প্রয়োজনের শতভাগ পাওয়া যায়নি। ২০১৭ সালে জেআরপি তহবিলের ৭৩ শতাংশ পাওয়া গেছে, ২০১৮ সালে ৭২ শতাংশ, ২০১৯ সালে ৭৫ শতাংশ, ২০২০ সালে ৬৫ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ৭২ শতাংশ পাওয়া গেছে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, পৃথিবীর অন্য জায়গায় কী হচ্ছে না হচ্ছে, সেটার সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যু মেলানো ঠিক হবে না। বরং রোহিঙ্গা বিষয়ে সমাধান যেটা প্রয়োজন সেটার জন্য মিয়ানমার সরকারের ওপর কী ধরনের চাপ বাড়ানো যায় এবং কতখানি বাড়ানো যায় সেটা খেয়াল রাখা দরকার। আমার মনে হয়, সেটার ওপরে নজহর রাখা জরুরি। তিন বছর পর আমরা দেখলাম যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করেছে, মিয়ানমারে একটা গণহত্যা হয়েছে। এটা তো আগে ছিল না। এটা একটা নতুন বিষয় যুক্ত হলো। এটা বড় একটা ডেভলপমেন্ট।

যুক্তরাষ্ট্রের গণহত্যার স্বীকৃতি বাংলাদেশকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন আন্তর্জাতিক এ বিশ্লেষক। তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য রাখা দরকার যুক্তরাষ্ট্র পদক্ষেপ নিচ্ছে কি না এবং এ ব্যাপারে গণমাধ্যমের উচিত তাদের কাছে জানতে চাওয়া। কারণ, ঘোষণা করে চুপ করে থাকলে তো কোনো মানে হলো না। দেখা দরকার যুক্তরাষ্ট্রের যারা বন্ধু রাষ্ট্র তারাও একই সুরে এটাকে গণহত্যা বলে কিনা বা সেদিকে নিয়ে যাওয়া। সে জায়গায় ফোকাসটা করতে হবে। আমরা চুপ করে থাকলে হবে না। সে জায়গায় আমাদের নিয়ে যাওয়া দরকার। নিষেধাজ্ঞা আবার চালু করবে কিনা বা অন্য দেশ নিষেধাজ্ঞা চালু করে কিনা এ বিষয়ে আমাদের বড় আকারে ফোকাস করতে হবে।

এদিকে ২০ জুন বিশ্ব শরণার্থী দিবস সামনে রেখে গতকাল কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে সমাবেশ করেন রোহিঙ্গারা। প্রায় ১৫ হাজার রোহিঙ্গার উপস্থিতিতে ‘নির্যাতিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠেী’ ব্যানারে ‘গো হোম’ বা ‘বাড়ি চলো’ সমাবেশ থেকে মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়ে সাত দফা ঘোষণা করা হয়।

বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের আর কোনো দেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশকে এখন এই ১২ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা টানতে হচ্ছে। এ সমস্যা নিয়ে দীর্ঘদিন আলাপ-আলোচনা হলেও এর কোনো সমাধান এখনও আসেনি।

সাত দফা দাবিগুলো হচ্ছে- দ্রুত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন, ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন বাতিল, দ্রুত রোহিঙ্গাদের নিজ নিজ গ্রামে (রাখাইন রাজ্যে) প্রত্যাবাসন, রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কার্যকর করা, রাখাইন রাজ্যে আইডিপি ক্যাম্প বন্ধ করা ও তাদের (রোহিঙ্গাদের) নিজ গ্রামে ফিরিয়ে নেওয়া এবং মিয়ানমারে নিরপরাধ লোকজনের ওপর (রোহিঙ্গা মুসলমান) অত্যাচার বন্ধ করা।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল চার লাখের অধিক রোহিঙ্গা।

রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শুরুতে কথা বললেও ইদানিং আর তাদের জোরালো বক্তব্য শোনা যায় না।
আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন আজও শুরু হয়নি।

২০১৮ সালের নভেম্বর এবং ২০১৯ সালের আগস্টে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। ওই সময় রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা তুলে ফিরতে রাজি হয়নি রোহিঙ্গারা।